বঙ্গবন্ধুর ব্যতিক্রমী ভাস্কর্য

 

নেত্রকোনা: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বাঙালির আবেগের শেষ নেই। এই মহান নেতাকে নিয়ে আগে অনেক শিল্পী মূর্তি বানিয়েছেন, প্রতিকৃতি এঁকেছেন। তার জীবদ্দশার বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি নকল করে আলাদা আলাদা ভাস্কর্য এবং প্রতিকৃতি রয়েছে সারা দেশেই।

কিন্তু একটি ভাস্কর্যেই সেসব মুহূর্তের অবিকল অঙ্গ-ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়ত কেউ করেননি। আর সে কাজটিই করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টার গোপালপুর গ্রামের এক সাধারণ শিল্পী গোলাম মোস্তফা।

কখনো তর্জনি উঁচিয়ে, কখনো নিরাবেগ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অথবা হাতে সেই পাইপ নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসা অবস্থার জীবন্ত ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন তিনি। সাধারণ শিল্পীর এ অসাধারণ শিল্পকর্ম দেখে অভিভূত এলাকাবাসী। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে ভাস্কর্যটি দেখতে।

পাথর খোদাই করে নয়, রড-সিমেন্ট কিংবা আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও নয়; শুধু কাঠ, ফোম আর রংতুলি দিয়ে তৈরি এ ভাস্কর্য একেবারেই ব্যতিক্রমী। ভাস্কর্যটির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ও দুর্লভ মুহূর্তগুলো ইচ্ছেমতো ফুটিয়ে তোলা যায় এতে।

কখনো তর্জনি উঁচিয়ে ভাষণ দেওয়া অবস্থায়, কখনো ছোট্ট টেবিলে বসে দু’আঙ্গুলের ফাঁকে প্রিয় পাইপ রেখে কারও সঙ্গে নিবিষ্ট মনে আলাপ, কখনো দাঁড়িয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দেখা যায় গোলাম মোস্তফার এ একটি ভাস্কর্যেই।

গায়ে সাদা পাঞ্জাবি,  বিখ্যাত হাতাকাটা কালো কোট, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা আর পায়ে কালো স্যান্ডেল। চেহারায় শৌর্যবীর্য ও ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে এ শিল্পকর্মে।

এ ভাস্কর্যের ব্যাপারে বারহাট্টা উপজেলা চেয়ারম্যান খায়রুল কবির খোকন বাংলানিউজকে বলেন, ‘গোলাম মোস্তফা তার মেধা ও শ্র্রম দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি তৈরি করে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ছেলে-বুড়োরা প্রতিদিনই এটি দেখতে আসে।’

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ভাস্কর্য আর দ্বিতীয়টি নেই বলেও মনে করেন সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতা।

কাষ্ঠনির্মিত আলাদা এ ভাস্কর্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাস্কর গোলাম মোস্তফা খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলানিউজের স্থানীয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে।

তিনি জানান, ১৯৯৭ সালের দিকে মাটি দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে মাথার আকৃতি তৈরি করেন তিনি। সফল হওয়ার পর কাঠ দিয়ে সম্পূর্ণ মূর্তি নির্মাণের কাজ হাতে নেন।

মাঝে আর্থিক অনটনের কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয় মোস্তফাকে। ২০০৮ সালের পর আবার কাজ শুরু করেন। শত আর্থিক সংকটের মাঝেও তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন জাতির পিতার এই প্রতিকৃতি। নিজের সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করেছেন এতে। ঢেলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জন্য পুষিয়ে রাখা সব আবেগ।

তিনি বলেন, ‘আমার পণ ছিল যেভাবেই হোক জাতির পিতার ভাস্কর্য তৈরি করব। সে লক্ষ্যে পেশাগত কাজের পাশাপাশি এই কাজও শুরু করি।’

ভাস্কর্য শিল্পে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই গোলাম মোস্তফার। স্বপ্ল জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা পুঁজি শুধু তীব্র আবেগের বশেই এ কাজে তিনি হাত দেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে। তখন দশম শ্রেণীতে পড়ি। বারহাট্টা রেলওয়ে স্টেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন নির্বাচনী প্রচারণায়। এসময় তার ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হই। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন আমার আদর্শ।’

সেই অনুপ্রেরণা থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি।

ভাস্কর্যটি নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে  শিল্পী গোলাম মোস্তফা জানান, ছাতিম কাঠ দিয়ে এটি তৈরি। ভাস্কর্যের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গ আলাদাভাবে কাঠের টুকরো বানিয়ে স্ক্রুর সাহায্যে জোড়া লাগানো। এরপর কাঠের গায়ে ফোম ও রং ব্যবহার করা হয়েছে। এতে মূর্তির গায়ে হাত দিলে যে কারো জীবন্ত মনে হবে।

তিনি বলেন, এ ভাস্কর্যের বড় বিশেষত্ব হলো বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গি। দর্শনার্থীরা যেভাবে দেখতে চান ঠিক সেভাবেই দেখতে পান বঙ্গবন্ধুকে। ভাস্কর্যের জয়েন্টগুলোকে একটু নড়-চড় করে নানা ভঙ্গিতে প্রদর্শন করা যায়।

বিশিষ্ট কবি নির্মলেন্দু গুণ সম্প্রতি গোলাম মোস্তফার বাড়িতে গিয়ে ভাস্কর্যটি দেখেছেন। তিনি বাংলানিউজকে মুঠোফোনে বলেন, ‘এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর যত প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য দেখেছি, সবগুলোই স্থির। কিন্তু শিল্পী গোলাম মোস্তফার গড়া ভাস্কর্যটি সম্পূর্ণ ভিন্ন।’

শিল্পীর শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়েছি  উল্লেখ করে কবি বলেন, ‘এই ভাস্কর্যের অন্যতম আর্কষণ ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো একেক সময় একেকভাবে প্রকাশ করা যায়।’

আগামী ১৫ জুন বারহাট্টার কাশবনে “বীরচরণ” মঞ্চে এই শিল্পকর্মটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের কথা রয়েছে। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৩টায় কবি নির্মলেন্দু গুনের সভাপতিত্বে যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছেন কাশবন পরিচালনা পরিষদের মহাপরিচালক এবং কবি নির্মলেন্দু গুণের সহোদর নীহারেন্দু গুণ চৌধুরী।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে এই সৃষ্টিকর্ম তুলে দেওয়ার আশা গোলাম মোস্তফার। তিনি বলেন, ‘আমি চাই জাতির জনককে নিয়ে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস বঙ্গবন্ধু জাদুঘর অথবা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হোক।’

এতে বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ও ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো দেখে তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশ ও জাতির প্রতি ভালবাসা জন্মিলে তবেই আমার শ্রম স্বার্থক হবে- বলেন শিল্পী গোলাম মোস্তফা।

মাহবুব আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, জুন ১৩, ২০১২